1:21 AM
সহস্রাব্দের উন্নয়ন ধুমধাম ধামাকা
mazhar's net
আজ বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবী নিবিড়ভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গেও এমনভাবে যুক্ত, যা আগে কোনো দিন ছিল না। কিন্তু সার্বভৌম ও স্বাধীন সত্তায় পৃথিবী কোনো দিন এত বিভক্ত ছিল না। সাম্রাজ্যের যুগে তো নয়ই। আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে যেসব রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, তাদের বহু রাষ্ট্র কোনো না কোনো সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেকালের ওই সব রাষ্ট্রের যে অবস্থা ছিল, তার চেয়ে অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রশ্নটি এখন নানা দেশে অমীমাংসিত। দেশে-বিদেশে ও প্রতিবেশী দেশে দৃষ্টান্তের ও আশঙ্কার অভাব নেই।
বর্তমান বিশ্বে প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ আজ অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা ভোগ করছে। অপরদিকে আর এক বিলিয়ন মানুষ নিঃসহায়, দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কেউ কারও দায়িত্ব নিতে চায় না। আমরা কি কেবল নৈতিক দায়বশত এ অবস্থার পরিবর্তন চাইব? এ অবস্থায় পৃথিবীর সার্বিক নিরাপত্তা রক্ষা করা কতখানি সম্ভব? বর্তমান বিশ্বের কূটনীতিকদের সম্মুখে বড় প্রশ্ন, বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাস, আন্তর্জাতিক অপরাধ, বৈশ্বিক দারিদ্র্য ও মানবিক সমস্যা। সমস্যাগুলো বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশে। সমস্যার কারণ বহুলাংশে উন্নত দেশগুলোর অমানবিক শোষণ। ভাগ্যোন্নয়নে উন্নয়নশীল দেশের অপারগতা এবং কোনো কোনো দেশে ভাগ্য পরিবর্তনে অনীহা বা অনিচ্ছা। উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অক্ষমতার প্রকাশ পায় সাধারণত তিনভাবে। নিরাপত্তা বিধানে, নাগরিকদের প্রাথমিক প্রয়োজন মেটাতে ও রাজনৈতিক বৈধতা অর্জনে ব্যর্থতার কারণে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে। পৃথিবীর বেশ কিছু রাষ্ট্র তিনটি বিষয়ে কৃতকার্যতা অর্জন করেনি। সেই নিয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রের প্রশ্ন উঠেছে। যেকোনো একটি প্রসঙ্গে প্রায় ৫০টি রাষ্ট্রের অপারগতা রয়েছে। প্রায় ৩১টি দেশে সশস্ত্র সংঘাত বিরাজমান। আবার বেশ কিছু রাষ্ট্রের পতাকা দুর্বৃত্তদের হাতে।
অনেক রাষ্ট্রে নাগরিকদের প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ্য নেই। এই অক্ষমতার প্রধান কারণ দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের সঙ্গে অনিরাপত্তা, সংঘাত ও অধিকতর দারিদ্র্যের প্রশ্ন জড়িত। কিছু কিছু দেশকে গৌরবেও উন্নয়নশীল দেশ বলা যাচ্ছে না। তারা প্রায় পতনোন্মুখ রাষ্ট্র। এই করুণ অবস্থা নিরসনের উপায় কী? দারিদ্র্য জাদুঘরে পাঠানোর কথা শ্রুতিমধুর। কেউ বিশ্বাস করে না। বিবেকের দংশনে এবং মানবমর্যাদার প্রতি বাঁ-হাতি আনুগত্য প্রকাশের জন্যই হোক, গত কয়েক শতাব্দীতে নানা মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। আগে এই অমানবেতর অবস্থাকে বিধির বিধান বলে মেনে মানুষ তার অবস্থা মেনে নিয়েছে, বা মানতে বাধ্য হয়েছে বা তার পরিবর্তন করতে চেয়েছে বা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সাহায্য করার প্রশ্ন উঠলে সাহায্য পাওয়ার যোগ্যতার ওপর প্রশ্ন ওঠে। সাহায্য নেওয়ার জন্য যে খরচাপাতি, সুদ ইত্যাদি দিতে হবে, তা পরিশোধ করার যোগ্যতা নিরূপণ করবে, যারা সাহায্যের ব্যবসায় নিয়োজিত। ঘরের ধান খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে কেউ রাজি নয়। মোষ তাড়াতে গিয়ে বাণিজ্যের দ্বার খুলে যায়, ভিন্ন কথা।
২০০০ সালের ৬, ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর সহস্রাব্দের শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে জাতিসংঘ। ওই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ১০০ জন রাষ্ট্রপ্রধান, ৪৭ জন সরকারপ্রধান, পাঁচজন উপরাষ্ট্রপতি এবং তিনজন উপপ্রধানমন্ত্রী। তৎকালীন জাতিসংঘের ১৯২ সদস্যের আট হাজার প্রতিনিধি এবং সাড়ে পাঁচ হাজার সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। বিশ্বের ইতিহাসের বিশ্বনেতাদের সে এক বৃহত্তম সমাবেশ। ওই অনুষ্ঠান উপলক্ষে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেরও একটি বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ তখন নিরাপত্তা পরিষদের এক নির্বাচিত সদস্য। সহস্রাব্দের শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন এবং নিরাপত্তা পরিষদে বাংলা ভাষায় তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। মধ্যবর্তী শীর্ষ সম্মেলনে ২০০৫ সালে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেপ্টেম্বর ২০১০ সালের শীর্ষ সম্মেলনে শেখ হাসিনা অংশ নেন এবং শিশুমৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ হ্রাসের সাফল্যের জন্য পুরস্কৃত ও অভিনন্দিত হন। উন্নয়নশীল আরও পাঁচটি দেশ পুরস্কৃত হয়।
২০১৫ সালের মধ্যে অর্জনের লক্ষ্য রেখে আটটি বিষয়ে লক্ষ্যমাত্রা চিহ্নিত করা হয়। বিষয়গুলো হচ্ছে মানবজাতিকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা থেকে মুক্তিদান, সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা, পুরুষ ও নারীর মধ্যে জীবিকা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, এইডস, এইচআইভি, ম্যালেরিয়ার মতো রোগ দূরীকরণ, মাতৃত্বজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যু দূরীকরণ, সুস্থ পরিবেশ বজায় রেখে উন্নতীকরণ ও ধনী-দরিদ্র এবং বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অংশীদারির নতুন সমীকরণ গড়ে তোলা।
১৯৯০ সালে নবজাতক এক হাজার শিশুর মধ্যে ১৪৯ জন মারা যেত, এখন তা কমে এসে ৫৪-তে দাঁড়িয়েছে। সহস্রাব্দ শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী সভায় সভাপতিত্বকালে বাংলাদেশ ২০১৫ সালের মধ্যে সব লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন করতে পারবে বলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী আশা ব্যক্ত করেছেন ও বলেছেন যে বাস্তবায়নের জন্য আমাদের প্রয়োজন হবে বার্ষিক ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক সাহায্য। অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি করতে পেরেছে। সবার জন্য শিক্ষার ক্ষেত্রে ১৯৯০ সালে যেখানে শতকরা ৬১ ভাগ শিশু স্কুলে যেত, তা ৯২ ভাগে উন্নীত হয়েছে।
দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রেও আমাদের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। দারিদ্র্যের হার শতকরা ৬০ থেকে ৩৭ ভাগে নেমে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২১ সালের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে শতকরা ১০০ ভাগ শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান নিশ্চিত করার প্রয়াসে বাংলাদেশ কাজ করে যাবে। ২০১৫ সালের মধ্যে নারী-পুরুষের মধ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর হবে ও চাকরির ক্ষেত্রে শতকরা ৫০ ভাগ নারীর প্রতিনিধিত্ব সিট সংরক্ষণ করা হবে। তিনি আরও ঘোষণা দিয়েছেন, শিশু ও মায়ের মৃত্যুর হার কমানো হবে, সব নাগরিককে পানি ও উন্নত জীবনের সব ব্যবস্থা দেওয়া হবে। ধনী দেশগুলোর ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনে তাদের জাতীয় সার্বিক আয়ের শতকরা ০.৭ ভাগ এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মাত্র পাঁচটি ইউরোপীয় দেশ—নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড ও লুক্সেমবার্গ—এই প্রতিশ্রুত সাহায্য দিয়েছে। বাকি শিল্পোন্নত দেশগুলোর সাহায্যের পরিমাণ ও হার ছিল নগণ্য। যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় আয়ের মাত্র ০.২ ভাগ হারে সাহায্য দিয়েছে।
২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবে। সে সময় বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীও উদ্যাপিত হবে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশ সম্প্রতি যে গতিতে উন্নয়ন অর্জন করে চলেছে, তাতে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মাঝারি আয়ের দেশে পরিণত করা অসম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের উদীয়মান ৩০টি শিল্পোন্নত দেশের একটি হিসেবে আবির্ভূত হবে। বাংলাদেশকে এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করতে এবং অর্থনৈতিক অর্জন ধরে রাখতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো ২০১১-১৫ অনুসারে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ আট শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। শিল্পনীতি ২০১০-এ ২০১৩ সালে আট শতাংশ এবং ২০১৭ সালে ১০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ছয় শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে জিডিপি অর্জন করবে বলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
আমরা যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধির নির্ধারিত হার অর্জন করতে চাই তাহলে আমাদের কৃষির পাশাপাশি শিল্প খাতের ওপর জোর দিতে হবে। পাঁচ বছরের মধ্যে আট শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে মোট ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে তিন লাখ ছয় হাজার ৫৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। আগামী পাঁচ বছরে মোট ১১ লাখ ৮৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হলে বিনিয়োগের ঘাটতি পড়বে তিন লাখ ৪৪ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে গত ১০ বছরের মতো বিনিয়োগ-গতি ধরে রাখা সম্ভব না-ও হতে পারে। আগামী পাঁচ বছরে নির্ধারিত মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে প্রতিবছর গড়ে ১৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ হারে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের বিনিয়োগের হার এখন মোট জিডিপির মাত্র ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। সরকার-নির্ধারিত আগামী পাঁচ বছরে বিনিয়োগের হার ৩২ শতাংশে উন্নয়নের লক্ষ্যে জিডিপির মোট পরিমাণ ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকায় উন্নীত করতে হবে। আমাদের যে পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে, তার বেশির ভাগই আসবে বেসরকারি খাত থেকে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়লেও তা হয়েছে মূলত অনুৎপাদনশীল খাতে। বিনিয়োগ যদি অনুৎপাদনশীল খাতে হয়, সেটা সরকারি বা বেসরকারি যে সেক্টরেই হোক, তা দেশের অর্থনীতির জন্য তেমন মঙ্গল বয়ে আনবে না।
১৯৭২-৭৩ সালে আমাদের দেশের রপ্তানি ছিল ৩৫ কোটি ডলারেরও নিচে। আজ গত চার দশকে তা ৩০ গুণ বেড়েছে। জাতীয় আয় বেড়েছে, তাই মাথাপিছু গড় আয় বেড়েছে। আবার একই সঙ্গে বেড়েছে বৈষম্য। দেশের ওপরের দিকের মাত্র পাঁচ শতাংশ ধনী জাতীয় আয়ের ৩০ শতাংশ ভোগ করে। সবচেয়ে গরিব পাঁচ শতাংশ মানুষ জাতীয় আয়ের মাত্র ০.৬৭ শতাংশ ভোগ করে। দৈনিক দুই ডলার আয় করা মানুষের সংখ্যা জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশ। আর দৈনিক এক ডলারের নিচে আয় করে অর্ধেক জনসমষ্টি। মাথাপিছু আয়, মোট জাতীয় আয় ইত্যাদি সংখ্যাতত্ত্ব বৈষম্যপূর্ণ সমাজের আসল খবর দেবে না। উন্নয়নের ১ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূলকরণ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের সাধারণ ক্ষুধার নিবৃত্তি না ঘটলে সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি এবং নিরাময়যোগ্য রোগব্যাধির হাত থেকে মানুষ মুক্তি পাবে না।
বাম চিন্তাবিদেরা বলছেন, নির্ধারিত সময়ের দুই-তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে গোটা বিশ্বের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ শিশুমৃত্যুহার হ্রাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও মাতৃস্বাস্থ্য আগের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদীরা বিশ্বব্যবস্থাকে একটি মানবিক চেহারা এবং অসহনীয় দারিদ্র্যকে একটা সহনীয় রূপ দেওয়ার জন্য সহস্রাব্দ উন্নয়নের নামে দয়ার্দ্র উপচিকীর্ষার কথা বলেছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর বহ্বাড়ম্বর লঘুক্রিয়ায় পর্যবসিত হবে। সহস্রাব্দের উন্নয়নের ধুমধাম ধামাকা চিঁ-চিঁ রবে অবশিত হবে।
মহাজনদের পরিকল্পনায় মহাজন-রাষ্ট্ররা সাহায্যের হাত তেমন না বাড়ালেও উন্নয়নশীল দেশের লোকে আশায়-আশায় স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছে। সেই আশার চিত্র পরস্ফুিট করতে শিল্পী সন্তু সাহা যে ১০টি পোস্টার নির্মাণ করেছেন, আমি আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে তা উদ্বোধন করি। ঢাকার জাতিসংঘ তথ্যকেন্দ্র, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ ও হোপ মাল্টিমিডিয়ার সম্মিলিত উদ্যোগে ওই প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা। সাবেক প্রধান বিচারপতি।
বর্তমান বিশ্বে প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ আজ অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা ভোগ করছে। অপরদিকে আর এক বিলিয়ন মানুষ নিঃসহায়, দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কেউ কারও দায়িত্ব নিতে চায় না। আমরা কি কেবল নৈতিক দায়বশত এ অবস্থার পরিবর্তন চাইব? এ অবস্থায় পৃথিবীর সার্বিক নিরাপত্তা রক্ষা করা কতখানি সম্ভব? বর্তমান বিশ্বের কূটনীতিকদের সম্মুখে বড় প্রশ্ন, বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাস, আন্তর্জাতিক অপরাধ, বৈশ্বিক দারিদ্র্য ও মানবিক সমস্যা। সমস্যাগুলো বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশে। সমস্যার কারণ বহুলাংশে উন্নত দেশগুলোর অমানবিক শোষণ। ভাগ্যোন্নয়নে উন্নয়নশীল দেশের অপারগতা এবং কোনো কোনো দেশে ভাগ্য পরিবর্তনে অনীহা বা অনিচ্ছা। উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অক্ষমতার প্রকাশ পায় সাধারণত তিনভাবে। নিরাপত্তা বিধানে, নাগরিকদের প্রাথমিক প্রয়োজন মেটাতে ও রাজনৈতিক বৈধতা অর্জনে ব্যর্থতার কারণে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে। পৃথিবীর বেশ কিছু রাষ্ট্র তিনটি বিষয়ে কৃতকার্যতা অর্জন করেনি। সেই নিয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রের প্রশ্ন উঠেছে। যেকোনো একটি প্রসঙ্গে প্রায় ৫০টি রাষ্ট্রের অপারগতা রয়েছে। প্রায় ৩১টি দেশে সশস্ত্র সংঘাত বিরাজমান। আবার বেশ কিছু রাষ্ট্রের পতাকা দুর্বৃত্তদের হাতে।
অনেক রাষ্ট্রে নাগরিকদের প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ্য নেই। এই অক্ষমতার প্রধান কারণ দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের সঙ্গে অনিরাপত্তা, সংঘাত ও অধিকতর দারিদ্র্যের প্রশ্ন জড়িত। কিছু কিছু দেশকে গৌরবেও উন্নয়নশীল দেশ বলা যাচ্ছে না। তারা প্রায় পতনোন্মুখ রাষ্ট্র। এই করুণ অবস্থা নিরসনের উপায় কী? দারিদ্র্য জাদুঘরে পাঠানোর কথা শ্রুতিমধুর। কেউ বিশ্বাস করে না। বিবেকের দংশনে এবং মানবমর্যাদার প্রতি বাঁ-হাতি আনুগত্য প্রকাশের জন্যই হোক, গত কয়েক শতাব্দীতে নানা মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। আগে এই অমানবেতর অবস্থাকে বিধির বিধান বলে মেনে মানুষ তার অবস্থা মেনে নিয়েছে, বা মানতে বাধ্য হয়েছে বা তার পরিবর্তন করতে চেয়েছে বা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সাহায্য করার প্রশ্ন উঠলে সাহায্য পাওয়ার যোগ্যতার ওপর প্রশ্ন ওঠে। সাহায্য নেওয়ার জন্য যে খরচাপাতি, সুদ ইত্যাদি দিতে হবে, তা পরিশোধ করার যোগ্যতা নিরূপণ করবে, যারা সাহায্যের ব্যবসায় নিয়োজিত। ঘরের ধান খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে কেউ রাজি নয়। মোষ তাড়াতে গিয়ে বাণিজ্যের দ্বার খুলে যায়, ভিন্ন কথা।
২০০০ সালের ৬, ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর সহস্রাব্দের শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে জাতিসংঘ। ওই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ১০০ জন রাষ্ট্রপ্রধান, ৪৭ জন সরকারপ্রধান, পাঁচজন উপরাষ্ট্রপতি এবং তিনজন উপপ্রধানমন্ত্রী। তৎকালীন জাতিসংঘের ১৯২ সদস্যের আট হাজার প্রতিনিধি এবং সাড়ে পাঁচ হাজার সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। বিশ্বের ইতিহাসের বিশ্বনেতাদের সে এক বৃহত্তম সমাবেশ। ওই অনুষ্ঠান উপলক্ষে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেরও একটি বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ তখন নিরাপত্তা পরিষদের এক নির্বাচিত সদস্য। সহস্রাব্দের শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন এবং নিরাপত্তা পরিষদে বাংলা ভাষায় তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। মধ্যবর্তী শীর্ষ সম্মেলনে ২০০৫ সালে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেপ্টেম্বর ২০১০ সালের শীর্ষ সম্মেলনে শেখ হাসিনা অংশ নেন এবং শিশুমৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ হ্রাসের সাফল্যের জন্য পুরস্কৃত ও অভিনন্দিত হন। উন্নয়নশীল আরও পাঁচটি দেশ পুরস্কৃত হয়।
২০১৫ সালের মধ্যে অর্জনের লক্ষ্য রেখে আটটি বিষয়ে লক্ষ্যমাত্রা চিহ্নিত করা হয়। বিষয়গুলো হচ্ছে মানবজাতিকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা থেকে মুক্তিদান, সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা, পুরুষ ও নারীর মধ্যে জীবিকা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, এইডস, এইচআইভি, ম্যালেরিয়ার মতো রোগ দূরীকরণ, মাতৃত্বজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যু দূরীকরণ, সুস্থ পরিবেশ বজায় রেখে উন্নতীকরণ ও ধনী-দরিদ্র এবং বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অংশীদারির নতুন সমীকরণ গড়ে তোলা।
১৯৯০ সালে নবজাতক এক হাজার শিশুর মধ্যে ১৪৯ জন মারা যেত, এখন তা কমে এসে ৫৪-তে দাঁড়িয়েছে। সহস্রাব্দ শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী সভায় সভাপতিত্বকালে বাংলাদেশ ২০১৫ সালের মধ্যে সব লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন করতে পারবে বলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী আশা ব্যক্ত করেছেন ও বলেছেন যে বাস্তবায়নের জন্য আমাদের প্রয়োজন হবে বার্ষিক ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক সাহায্য। অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি করতে পেরেছে। সবার জন্য শিক্ষার ক্ষেত্রে ১৯৯০ সালে যেখানে শতকরা ৬১ ভাগ শিশু স্কুলে যেত, তা ৯২ ভাগে উন্নীত হয়েছে।
দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রেও আমাদের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। দারিদ্র্যের হার শতকরা ৬০ থেকে ৩৭ ভাগে নেমে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২১ সালের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে শতকরা ১০০ ভাগ শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান নিশ্চিত করার প্রয়াসে বাংলাদেশ কাজ করে যাবে। ২০১৫ সালের মধ্যে নারী-পুরুষের মধ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর হবে ও চাকরির ক্ষেত্রে শতকরা ৫০ ভাগ নারীর প্রতিনিধিত্ব সিট সংরক্ষণ করা হবে। তিনি আরও ঘোষণা দিয়েছেন, শিশু ও মায়ের মৃত্যুর হার কমানো হবে, সব নাগরিককে পানি ও উন্নত জীবনের সব ব্যবস্থা দেওয়া হবে। ধনী দেশগুলোর ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনে তাদের জাতীয় সার্বিক আয়ের শতকরা ০.৭ ভাগ এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মাত্র পাঁচটি ইউরোপীয় দেশ—নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড ও লুক্সেমবার্গ—এই প্রতিশ্রুত সাহায্য দিয়েছে। বাকি শিল্পোন্নত দেশগুলোর সাহায্যের পরিমাণ ও হার ছিল নগণ্য। যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় আয়ের মাত্র ০.২ ভাগ হারে সাহায্য দিয়েছে।
২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবে। সে সময় বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীও উদ্যাপিত হবে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশ সম্প্রতি যে গতিতে উন্নয়ন অর্জন করে চলেছে, তাতে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মাঝারি আয়ের দেশে পরিণত করা অসম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের উদীয়মান ৩০টি শিল্পোন্নত দেশের একটি হিসেবে আবির্ভূত হবে। বাংলাদেশকে এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করতে এবং অর্থনৈতিক অর্জন ধরে রাখতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো ২০১১-১৫ অনুসারে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ আট শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। শিল্পনীতি ২০১০-এ ২০১৩ সালে আট শতাংশ এবং ২০১৭ সালে ১০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ছয় শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে জিডিপি অর্জন করবে বলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
আমরা যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধির নির্ধারিত হার অর্জন করতে চাই তাহলে আমাদের কৃষির পাশাপাশি শিল্প খাতের ওপর জোর দিতে হবে। পাঁচ বছরের মধ্যে আট শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে মোট ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে তিন লাখ ছয় হাজার ৫৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। আগামী পাঁচ বছরে মোট ১১ লাখ ৮৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হলে বিনিয়োগের ঘাটতি পড়বে তিন লাখ ৪৪ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে গত ১০ বছরের মতো বিনিয়োগ-গতি ধরে রাখা সম্ভব না-ও হতে পারে। আগামী পাঁচ বছরে নির্ধারিত মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে প্রতিবছর গড়ে ১৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ হারে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের বিনিয়োগের হার এখন মোট জিডিপির মাত্র ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। সরকার-নির্ধারিত আগামী পাঁচ বছরে বিনিয়োগের হার ৩২ শতাংশে উন্নয়নের লক্ষ্যে জিডিপির মোট পরিমাণ ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকায় উন্নীত করতে হবে। আমাদের যে পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে, তার বেশির ভাগই আসবে বেসরকারি খাত থেকে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়লেও তা হয়েছে মূলত অনুৎপাদনশীল খাতে। বিনিয়োগ যদি অনুৎপাদনশীল খাতে হয়, সেটা সরকারি বা বেসরকারি যে সেক্টরেই হোক, তা দেশের অর্থনীতির জন্য তেমন মঙ্গল বয়ে আনবে না।
১৯৭২-৭৩ সালে আমাদের দেশের রপ্তানি ছিল ৩৫ কোটি ডলারেরও নিচে। আজ গত চার দশকে তা ৩০ গুণ বেড়েছে। জাতীয় আয় বেড়েছে, তাই মাথাপিছু গড় আয় বেড়েছে। আবার একই সঙ্গে বেড়েছে বৈষম্য। দেশের ওপরের দিকের মাত্র পাঁচ শতাংশ ধনী জাতীয় আয়ের ৩০ শতাংশ ভোগ করে। সবচেয়ে গরিব পাঁচ শতাংশ মানুষ জাতীয় আয়ের মাত্র ০.৬৭ শতাংশ ভোগ করে। দৈনিক দুই ডলার আয় করা মানুষের সংখ্যা জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশ। আর দৈনিক এক ডলারের নিচে আয় করে অর্ধেক জনসমষ্টি। মাথাপিছু আয়, মোট জাতীয় আয় ইত্যাদি সংখ্যাতত্ত্ব বৈষম্যপূর্ণ সমাজের আসল খবর দেবে না। উন্নয়নের ১ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূলকরণ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের সাধারণ ক্ষুধার নিবৃত্তি না ঘটলে সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি এবং নিরাময়যোগ্য রোগব্যাধির হাত থেকে মানুষ মুক্তি পাবে না।
বাম চিন্তাবিদেরা বলছেন, নির্ধারিত সময়ের দুই-তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে গোটা বিশ্বের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ শিশুমৃত্যুহার হ্রাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও মাতৃস্বাস্থ্য আগের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদীরা বিশ্বব্যবস্থাকে একটি মানবিক চেহারা এবং অসহনীয় দারিদ্র্যকে একটা সহনীয় রূপ দেওয়ার জন্য সহস্রাব্দ উন্নয়নের নামে দয়ার্দ্র উপচিকীর্ষার কথা বলেছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর বহ্বাড়ম্বর লঘুক্রিয়ায় পর্যবসিত হবে। সহস্রাব্দের উন্নয়নের ধুমধাম ধামাকা চিঁ-চিঁ রবে অবশিত হবে।
মহাজনদের পরিকল্পনায় মহাজন-রাষ্ট্ররা সাহায্যের হাত তেমন না বাড়ালেও উন্নয়নশীল দেশের লোকে আশায়-আশায় স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছে। সেই আশার চিত্র পরস্ফুিট করতে শিল্পী সন্তু সাহা যে ১০টি পোস্টার নির্মাণ করেছেন, আমি আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে তা উদ্বোধন করি। ঢাকার জাতিসংঘ তথ্যকেন্দ্র, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ ও হোপ মাল্টিমিডিয়ার সম্মিলিত উদ্যোগে ওই প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা। সাবেক প্রধান বিচারপতি।
1:12 AM
বিচার প্রশাসনে প্রহসন
mazhar's net
বিচার প্রশাসনে ঠিক দলীয়করণ চলছে না। চলছে অন্য কিছু। আরও ক্ষতিকর কিছু, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের ফলে যত বড় সুফল আশা করেছিলাম তা মিলছে না।
এক যুগ্ম জেলা জজ বদলি চেয়েছিলেন। মাদারীপুর থেকে ঢাকায় আসবেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০১ তিনি আবেদন করেন। সেটা পৃথক্করণের আগের কথা।
রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, তখনকার স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, তখনকার ডেপুটি স্পিকার। সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, তখন পরিবেশমন্ত্রী। আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন, তখন বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী। আমির হোসেন, তখন খাদ্যমন্ত্রী। মোহাম্মদ নাসিম, তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আবদুর রাজ্জাক, তখন পানিসম্পদমন্ত্রী। মন্ত্রী সাতজন। প্রায় সবাই ডাকসাইটে। সবাই ওই জজকে ঢাকায় আনতে জোরালো সুপারিশ করেন। এই জজ মুক্তিযোদ্ধা। ঘরে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি রাখেন। তাঁর প্রয়াত শ্বশুর আওয়ামী লীগের টিকিটে তিন মেয়াদে সাংসদ। শাশুড়ি আইভি রহমানের সঙ্গে মহিলা সংস্থার সক্রিয় নেত্রী ছিলেন। এ রকম একটি বিরল আবেদন দাখিল হলো। এর পরও আওয়ামী লীগ চার মাস ক্ষমতায় থাকল। কিন্তু ওই জজ বদলি হতে পারলেন না। এতে আমরা প্রমাণ পাই, আওয়ামী লীগপন্থী হলেই কাজ হয় না। আরও কিছু চাই। সেটা না থাকলে ভাগ্যের চাকা ঘোরে না। এরপর আসে ২০০৬ সাল। একটি বেনামী চিঠি আসে। তাতে ওই জজের বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ। দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাব খাটানোর দীর্ঘ ফিরিস্তি। মওদুদ আহমদ আইনমন্ত্রী। ৪ জানুয়ারি ২০০৫ সচিবকে তিনি লিখলেন, রিপোর্ট দিন। ৮ সেপ্টেম্বর ২০০৫ তাঁর নামে অভিযোগনামা তৈরি হলো। সেখানে শুধু বলা হলো, ‘আপনি বদলির আবেদনপত্রে কয়েকজন মাননীয় মন্ত্রী ও রাজনৈতিক ব্যক্তির সুপারিশ গ্রহণ করেন, যা একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার জন্য অনুচিত।’ ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী বিধি মোতাবেক অসদাচরণের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ।
৮ নভেম্বর ২০০৭। আইন মন্ত্রণালয়ের আদেশে লেখা হলো, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে আপনার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মোকদ্দমা করা হয়েছিল। এতে বিভিন্ন মন্ত্রী ও রাজনৈতিক ব্যক্তির সুপারিশ প্রকাশ পায়। তবে দুর্নীতির কোনো অপরাধ প্রমাণ হয়নি। সরকার আপনাকে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তা অনুমোদন করেননি। তাঁরা ১৯৮৫ সালের আইনের ৪(২)ক বিধি মোতাবেক ভর্ৎসনা প্রদানের জন্য অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ভাগ্যিস সুপ্রিম কোর্ট মাননীয় সুপারিশদাতাদের মান রক্ষা করেছিলেন! এ ঘটনার এখানেই ইতি ঘটে। কিন্তু এসিআর (বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন) খারাপের জন্য তাঁকে পরে অতিরিক্ত জেলা জজ করা হয়নি। ওই জজ ২০০৯ সালে অবসরে যান। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা-পাবলিক সারভেন্টদের বয়সসীমা বৃদ্ধি করেন। মাত্র তিন জজ এর সুবিধা পান। ওই জজ তাঁদের অন্যতম। তিনি তাই চাকরি ফিরে পান। এখন তাঁর আশা, অতিরিক্ত জেলা জজ হবেন। তবে সবচেয়ে বড় কথা, তিনি আজও ঢাকায় বদলি হতে পারেননি। তাঁর কর্মস্থল এখন নীলফামারী। তাহলে আমরা দেখলাম, কট্টর ‘আওয়ামী লীগার’ হয়েও ঢাকার কর্মস্থল তাঁর জুটল না।
২৮ মার্চ, ২০০৮। ফুলকোর্ট (হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকদের সভা) ৪০ জন অতিরিক্ত জেলা জজকে জেলা জজ পদে উন্নীত করার প্রস্তাব অনুমোদন করেন। এর মধ্যে অন্তত ১৬ জনের এসিআরে নানা নেতিবাচক মন্তব্য ছিল। যেমন বিচারকাজে অদক্ষতা, পক্ষপাতিত্ব, বুদ্ধিবৃত্তিক সততা সন্তোষজনক না থাকা, জীবনযাত্রার ধরন আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না থাকা ইত্যাদি। কিন্তু এসব তাঁদের পদোন্নতি পেতে বাধা হয়নি।
এর আগে (প্রধান বিচারপতির কাছে প্রথম ১০০ দিনের চাওয়া) লিখেছিলাম, গোটা অধস্তন আদালত তাকিয়ে আছেন ঢাকা জেলা জজ পদে নিয়োগ-প্রক্রিয়ার দিকে। আমাদের আশঙ্কাই সত্যি হলো। সরকারের কিংবা আইন মন্ত্রণালয়ের বা মহলবিশেষের পছন্দের লোকই নিয়োগ পেলেন। আমরা অবাক হলাম। কিন্তু কারণ বুঝলাম না। অন্তত ১৯০ জন জেলা জজকে ডিঙানো হলো। সর্বকনিষ্ঠকে নিয়োগের এই ঘটনাকে কী বলা হবে? যোগ্যতম ব্যক্তি বলেই কি? এ যোগ্যতার রূপ ও মানদণ্ড কী? এসিআরে বিরূপ মন্তব্য থাকা ওই ১৬ জনের তিনি ছিলেন অন্যতম। ২০০৮ সালে দেশে জরুরি অবস্থা ছিল। তাঁর পদোন্নতি পেতে অসুবিধা হয়নি। এই জজ ও তাঁর পরিবার ভৈরবে আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে পরিচিত। রাষ্ট্রপতির পরিবারের সঙ্গে তাঁদের জানাশোনা লোকের জানা। অনেক পাঠক হয়তো ভাববেন, আমরা দলীয়করণ কিংবা পরিবারতন্ত্রের দৃষ্টান্ত খাড়া করছি। এবার মুশকিলে ফেললেন। তাহলে আমাদের যে একটা সদুত্তর পেতেই হবে। ওই বিচারকের চাকরিজীবনের প্রায় অর্ধেক সময় (সাতটি কর্মস্থল) কী করে ঢাকায় কাটল? ২০০৪ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বদলি হন। এর ৯৫ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার পদে যোগ দেন। একটানা পাঁচ বছর ঢাকায় কাটান। ২০০৯ সালে নরসিংদীতে বদলি হন। ৫১ দিনের মাথায় দুদকের মহাপরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড প্রসিকিউশন) হয়ে ফেরেন। কী জাদু। মুক্তিযোদ্ধা ওই বিচারক বেচারা। তিনি আওয়ামী মন্ত্রীদের সুপারিশ জোগাড় করেন, কিন্তু ঢাকায় একটি বদলি জোটে না।
আরেকটি উদাহরণ দিই। ঢাকায় কর্মরত একজন জ্যেষ্ঠ জেলা জজকে (যাঁর অবসর আসন্ন। বিধিমতে, তাঁর বদলি এখন শর্তসাপেক্ষ) খুলনায় বদলির প্রস্তাব করা হয়েছে। ৬ অক্টোবর ২০১০ আইন মন্ত্রণালয়ের ওই প্রস্তাব-সংক্রান্ত চিঠিটি একটি খাসা দলিল বটে। আগের লেখায় বলেছিলাম, একটি বদলি নীতিমালা হোক। ঢাকায় যাঁদের দীর্ঘকাল কেটেছে, তাঁদের বদলি করা হোক। এই মুহূর্তে পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে ঢাকায় থাকা জজের সংখ্যা প্রায় এক ডজন হবে। আসলে কতিপয় চেনামুখের একটি বলয় গড়ে উঠেছে। এঁরা ঘুরেফিরে ঢাকায় থাকেন। সে কারণে ৬ অক্টোবরের চিঠিটির একটি বাক্য আমাকে বেশ আকৃষ্ট করেছে। এতে লেখা আছে, ‘ঢাকায় তাঁর একটানা প্রায় পাঁচ বছর কর্মকাল হয়েছে। ফলে তাঁকে অন্যত্র বদলি করা আবশ্যক।’ আমরা আশা করব, এতে ব্যক্তিবিশেষের প্রতি নয়, এর মধ্যে সরকারি নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অন্তত সুপ্রিম কোর্ট সেভাবে নেবেন। সেটা নিতে তাঁরা ব্যর্থ হলে প্রহসন থামানো যাবে না।
আইন মন্ত্রণালয়ের তিন উপসচিব পদে তিন জজকে ‘সততা, যোগ্যতা ও দক্ষতা’ বিবেচনায় বদলির প্রস্তাব করা হয় একই দিনে। এতেও অভিনবত্ব আছে। তবে এটাই হোক প্রকৃত নীতি। এসব হয়তো ১৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা জিএ কমিটির বৈঠকে গেছে। প্রধান বিচারপতি জিএ কমিটি পুনর্গঠন করেছেন। হাইকোর্টের তিন বিচারক—আনোয়ারুল হক, এ কে এম ফজলুর রহমান ও হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে নিয়ে এই কমিটি হয়েছে। প্রথম দুজন জেলা জজ ছিলেন। তাই অনেকেই কমিটির পয়লা সিদ্ধান্তে বজ্রাহত হয়েছেন। কারণ, এক দিনও কোনো জেলায় জজিয়তি (জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে) করেননি। তেমন ব্যক্তি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ হবেন, সেটা গত ২০০ বছরে কেউ কল্পনা করেনি। তা ছাড়া এর আরও মাত্রা আছে। এক অর্থে এটা একটা অভ্যুত্থান। কারণ, ঢাকার জেলা জজ ছিলেন জ্যেষ্ঠ তালিকার শীর্ষে। তিনিই ছিলেন সমিতির সভাপতি। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তাঁকে এক বছর যেতেই সরানো হয়। অথচ যোগ্য বিবেচনায় তাঁকে হাইকোর্টের বিচারক করতে সুপারিশ করেছিলেন প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন।
দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারককে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের আগেই একটি রিট করা হয়েছিল। এতে প্রতিকার চাওয়া হয়, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে যাতে জ্যেষ্ঠতা বজায় রাখা হয়। এর শুনানি মুলতবি আছে। আমরা মনে করি, ঢাকা জেলা জজ নিয়োগের বৈধতাও রিটে চ্যালেঞ্জযোগ্য। ওই বিচারকের এসিআরে একাদিক্রমে চার জেলা জজ মন্তব্য করেছিলেন, তাঁর মামলা নিষ্পত্তির হার ‘অপর্যাপ্ত’। আওয়ামী ঘরানার অথচ অধিকতর যোগ্য এবং এসিআরও নিষ্কণ্টক, এ রকম জজ প্রথম জ্যেষ্ঠ ১০০ জনের মধ্যেও ছিল না, সেটা আমরা স্বাভাবিক বলে ভাবতে পারি না। আমরা ভাবতে পারি না, জোট সরকারের আমলে (২০০৬) একজন জেলা জজ (তিনি আবার ওই জজের ভগ্নিপতি) কী করে দূতাবাসে বদলি হন, এখনো বহাল থাকেন? আমরা বুঝতে পারি না, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কেন চিঠি দেয়। সুপ্রিম কোর্ট কী করে তা মেনে (গত অক্টোবর) নেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি পদে এক জেলা জজকে বসান। একজন লিয়েনে জাতিসংঘ মিশনে দুবার গেছেন। তাই বলি, বিচার প্রশাসনে প্রহসন চলছে।
প্রধান বিচারপতির একক ইচ্ছায় জিএ কমিটি হয়। কেবল হাইকোর্ট বিভাগ থেকে এতে বিচারক নেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর থেকেই এই ধারা চলছে। তবে এর মাধ্যমে সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটছে। জিএ কমিটিতে আপিল বিভাগের বিচারক রাখতে হবে। সংখ্যা বাড়াতে হবে। জিএ কমিটি ভেঙে নতুন আঙ্গিকে কোনো কাঠামোর কথাও ভাবা যায়। জরুরি অবস্থায় আমরা প্রধান বিচারপতি মো. রুহুল আমিনের একটি অত্যাশ্চর্য সংস্কার প্রস্তাবের কথা স্মরণ করতে পারি। তিনি ফুলকোর্টে প্রস্তাব এনেছিলেন, জিএ কমিটির সুপারিশ আর ফুলকোর্টে যাবে না। সেই সুপারিশ প্রধান বিচারপতির কাছেই পেশ করতে হবে এবং তিনিই তা চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করবেন। এ থেকে আমরা গন্ধ পাই। প্রধান বিচারপতিরা জজ নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগের একটা প্রবণতা দেখান। এটি মূলগতভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এটাই আমাদের পেছনে ফেলতে হবে।
১৯৯৬ সালে ফুলকোর্টের একটি সিদ্ধান্ত ছিল। তাতে প্রধান বিচারপতিকে জজ বদলি ইত্যাদি প্রশ্নে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে ফুলকোর্ট সেটা বাতিল করেন। তাঁরা জিএ কমিটিকে সব এখতিয়ার দিয়েছেন। আসলে ওই সিদ্ধান্তও সংবিধানসম্মত হয়নি। কারণ, আপিল বিভাগকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। তবে এখন জিএ কমিটিকে এড়িয়ে কাউকে বদলি করা একেবারেই বেআইনি হবে। সরকারি ইচ্ছায় সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার দপ্তরে অপসারণ ও আগমনী গান বড় বেসুরো ঠেকছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটা লড়াই অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট কি রণে ভঙ্গ দিলেন? ১১ অক্টোবর ২০০৯ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার মো. শওকত হোসেন (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারক) আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। সেটি জজদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলাসহ নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ প্রদান ও বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর সুপ্রিম কোর্ট একটি অবস্থান নিচ্ছিলেন। তাঁরাও প্রয়োজনে কোনো বিচারককে বদলির প্রস্তাব করতে পারবেন। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় তা মানতে রাজি হয়নি। এখানে একটা পরিহাস আছে। আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে থাকা জজ সাহেবরাই সরকারকে (মহলবিশেষ) পরামর্শ দেন যে এসবে সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার নেই। আর তাঁরাই যখন সুপ্রিম কোর্টে প্রেষণে আসেন, তখন তাঁরাই উল্টো পরামর্শ দেন। এর মানে হলো, ‘ক্ষমতা, তোমায় বড় ভালোবাসি।’
দুই তরফেই আমরা অবশ্য অস্বচ্ছতা ও অন্যায্যতা দেখেছি। এর বহু প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। তবে আমাদের একটি জায়গায় দাঁড়াতে হবে। আর সেটা হলো, বিচারক নিয়ন্ত্রণের ভরকেন্দ্র একটিই থাকবে। আর সেটা হতে হবে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত মানে কী, সেটা ঠিক করতে হবে। কোনো ধরনের কর্তৃত্বপরায়ণ, ব্যক্তির মেজাজ-মর্জিনির্ভর কোনো সিদ্ধান্তকে সুপ্রিম কোর্টের বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না। আইন মন্ত্রণালয় চাইছে, তারা যখন খুশি যাঁকে ইচ্ছা তাঁকে বদলির প্রস্তাব দেবে। সুপ্রিম কোর্ট রাজি না হলে অগ্রাহ্য করবে। কিন্তু নিজ থেকে বিকল্প প্রস্তাব বা সুপারিশ দিতে পারবে না। সুপ্রিম কোর্ট ইদানীং সেই ফতোয়া মেনে নিচ্ছেন। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরও হুমকির মুখে পড়ছে।
সুপ্রিম কোর্টকে অবশ্যই অধিকতর উন্নত ও স্বচ্ছ প্রস্তাব দিয়ে আইন মন্ত্রণালয়কে উপযুক্ত পাঠ দিতে হবে। শুধু সংবিধান ও রায় দেখিয়ে এ ধরনের অধিকারের অসতর্ক কিংবা অন্যায্য অনুশীলন সুফল দেবে বলেও মনে হয় না।
আমরা পঞ্চম সংশোধনী নিয়ে মাতম দেখছি। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি অনেক উত্তেজনাকর উক্তি দিচ্ছেন। আমরা শিগগিরই মুদ্রিত অবস্থায় নতুন সংবিধান পাচ্ছি। শুধু আফসোস হলো, সংশোধনীগুলোর সঙ্গে শাসনগত গুণগত মান বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। এসব সংশোধনীর আত্মা ও শ্বাসযন্ত্র হলো রাজনীতি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো। সেই স্বাধীনতা বাহাত্তরে মূল সংবিধানেই ন্যুব্জ ছিল। কারণ, বিচার বিভাগ কার্যকরভাবে পৃথক না করে তখন আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। উপরন্তু চতুর্থ সংশোধনীতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো ১১৬ অনুচ্ছেদ। এটা বাহাত্তরের সংবিধানের আদলে (তাহলে সব ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্ট ফিরে পাবেন) ফিরিয়ে আনতে হবে। সেটা না পাওয়া পর্যন্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ‘বাদ্যযন্ত্রের দূরবর্তী শব্দ’ হয়েই থাকবে। এটা বিচারপতি মো. আবদুল মতিনের উপমা। ১০ বিচারকের মামলায় তিনি যথার্থ অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে সে কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলাম। কিন্তু কথায় চিঁড়ে ভেজে না।
বিএনপি-আওয়ামী লীগ উভয়ে আদালত তাঁবে রাখতেই এককাট্টা। অনেকে সুপ্রিম কোর্টের জন্য স্বাধীন সচিবালয়ের কথা বলেন। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতিকে সচিবালয় গঠনের তাগিদ দিয়েছিলেন। সেই বিষয়ে বঙ্গভবন থেকে একটি পত্র পাঠানো হয় আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ে। সেটি ফিতাবন্দী হয়ে থাকার কথা, থাকছেও তা-ই।
একটি বিকল্প বলি। একটু নাটকীয় বটে। এত নাটকীয়তার মধ্যে বলতে দোষ কী! মাসদার হোসেন মামলার শুনানি কিন্তু এখনো চলমান। এখানে একটি সম্প্রসারিত বিচারিক উদ্যোগ হতে পারে। আদালতের স্বাধীনতায় সরব আইনজীবীদের কমতি নেই! তাঁদের বক্তব্য শুনে বর্তমান ১১৬ অনুচ্ছেদকে (যা দিয়ে সরকার নিম্ন আদালতের হাত মোচড়ায়) সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী ঘোষণা করা সম্ভব মনে করি। এবং সেই রায়েই বলে দেওয়া যায়, বাহাত্তরের সংবিধানে মূল ১১৬ অনুচ্ছেদটি পুনরুজ্জীবিত হলো। সংসদের দরকার নেই। বিজি প্রেস থেকে ছেপে নিলেই হলো। আহা এমন যদি হতো!
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
এক যুগ্ম জেলা জজ বদলি চেয়েছিলেন। মাদারীপুর থেকে ঢাকায় আসবেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০১ তিনি আবেদন করেন। সেটা পৃথক্করণের আগের কথা।
রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, তখনকার স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, তখনকার ডেপুটি স্পিকার। সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, তখন পরিবেশমন্ত্রী। আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন, তখন বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী। আমির হোসেন, তখন খাদ্যমন্ত্রী। মোহাম্মদ নাসিম, তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আবদুর রাজ্জাক, তখন পানিসম্পদমন্ত্রী। মন্ত্রী সাতজন। প্রায় সবাই ডাকসাইটে। সবাই ওই জজকে ঢাকায় আনতে জোরালো সুপারিশ করেন। এই জজ মুক্তিযোদ্ধা। ঘরে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি রাখেন। তাঁর প্রয়াত শ্বশুর আওয়ামী লীগের টিকিটে তিন মেয়াদে সাংসদ। শাশুড়ি আইভি রহমানের সঙ্গে মহিলা সংস্থার সক্রিয় নেত্রী ছিলেন। এ রকম একটি বিরল আবেদন দাখিল হলো। এর পরও আওয়ামী লীগ চার মাস ক্ষমতায় থাকল। কিন্তু ওই জজ বদলি হতে পারলেন না। এতে আমরা প্রমাণ পাই, আওয়ামী লীগপন্থী হলেই কাজ হয় না। আরও কিছু চাই। সেটা না থাকলে ভাগ্যের চাকা ঘোরে না। এরপর আসে ২০০৬ সাল। একটি বেনামী চিঠি আসে। তাতে ওই জজের বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ। দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাব খাটানোর দীর্ঘ ফিরিস্তি। মওদুদ আহমদ আইনমন্ত্রী। ৪ জানুয়ারি ২০০৫ সচিবকে তিনি লিখলেন, রিপোর্ট দিন। ৮ সেপ্টেম্বর ২০০৫ তাঁর নামে অভিযোগনামা তৈরি হলো। সেখানে শুধু বলা হলো, ‘আপনি বদলির আবেদনপত্রে কয়েকজন মাননীয় মন্ত্রী ও রাজনৈতিক ব্যক্তির সুপারিশ গ্রহণ করেন, যা একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার জন্য অনুচিত।’ ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী বিধি মোতাবেক অসদাচরণের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ।
৮ নভেম্বর ২০০৭। আইন মন্ত্রণালয়ের আদেশে লেখা হলো, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে আপনার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মোকদ্দমা করা হয়েছিল। এতে বিভিন্ন মন্ত্রী ও রাজনৈতিক ব্যক্তির সুপারিশ প্রকাশ পায়। তবে দুর্নীতির কোনো অপরাধ প্রমাণ হয়নি। সরকার আপনাকে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তা অনুমোদন করেননি। তাঁরা ১৯৮৫ সালের আইনের ৪(২)ক বিধি মোতাবেক ভর্ৎসনা প্রদানের জন্য অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ভাগ্যিস সুপ্রিম কোর্ট মাননীয় সুপারিশদাতাদের মান রক্ষা করেছিলেন! এ ঘটনার এখানেই ইতি ঘটে। কিন্তু এসিআর (বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন) খারাপের জন্য তাঁকে পরে অতিরিক্ত জেলা জজ করা হয়নি। ওই জজ ২০০৯ সালে অবসরে যান। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা-পাবলিক সারভেন্টদের বয়সসীমা বৃদ্ধি করেন। মাত্র তিন জজ এর সুবিধা পান। ওই জজ তাঁদের অন্যতম। তিনি তাই চাকরি ফিরে পান। এখন তাঁর আশা, অতিরিক্ত জেলা জজ হবেন। তবে সবচেয়ে বড় কথা, তিনি আজও ঢাকায় বদলি হতে পারেননি। তাঁর কর্মস্থল এখন নীলফামারী। তাহলে আমরা দেখলাম, কট্টর ‘আওয়ামী লীগার’ হয়েও ঢাকার কর্মস্থল তাঁর জুটল না।
২৮ মার্চ, ২০০৮। ফুলকোর্ট (হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকদের সভা) ৪০ জন অতিরিক্ত জেলা জজকে জেলা জজ পদে উন্নীত করার প্রস্তাব অনুমোদন করেন। এর মধ্যে অন্তত ১৬ জনের এসিআরে নানা নেতিবাচক মন্তব্য ছিল। যেমন বিচারকাজে অদক্ষতা, পক্ষপাতিত্ব, বুদ্ধিবৃত্তিক সততা সন্তোষজনক না থাকা, জীবনযাত্রার ধরন আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না থাকা ইত্যাদি। কিন্তু এসব তাঁদের পদোন্নতি পেতে বাধা হয়নি।
এর আগে (প্রধান বিচারপতির কাছে প্রথম ১০০ দিনের চাওয়া) লিখেছিলাম, গোটা অধস্তন আদালত তাকিয়ে আছেন ঢাকা জেলা জজ পদে নিয়োগ-প্রক্রিয়ার দিকে। আমাদের আশঙ্কাই সত্যি হলো। সরকারের কিংবা আইন মন্ত্রণালয়ের বা মহলবিশেষের পছন্দের লোকই নিয়োগ পেলেন। আমরা অবাক হলাম। কিন্তু কারণ বুঝলাম না। অন্তত ১৯০ জন জেলা জজকে ডিঙানো হলো। সর্বকনিষ্ঠকে নিয়োগের এই ঘটনাকে কী বলা হবে? যোগ্যতম ব্যক্তি বলেই কি? এ যোগ্যতার রূপ ও মানদণ্ড কী? এসিআরে বিরূপ মন্তব্য থাকা ওই ১৬ জনের তিনি ছিলেন অন্যতম। ২০০৮ সালে দেশে জরুরি অবস্থা ছিল। তাঁর পদোন্নতি পেতে অসুবিধা হয়নি। এই জজ ও তাঁর পরিবার ভৈরবে আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে পরিচিত। রাষ্ট্রপতির পরিবারের সঙ্গে তাঁদের জানাশোনা লোকের জানা। অনেক পাঠক হয়তো ভাববেন, আমরা দলীয়করণ কিংবা পরিবারতন্ত্রের দৃষ্টান্ত খাড়া করছি। এবার মুশকিলে ফেললেন। তাহলে আমাদের যে একটা সদুত্তর পেতেই হবে। ওই বিচারকের চাকরিজীবনের প্রায় অর্ধেক সময় (সাতটি কর্মস্থল) কী করে ঢাকায় কাটল? ২০০৪ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বদলি হন। এর ৯৫ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার পদে যোগ দেন। একটানা পাঁচ বছর ঢাকায় কাটান। ২০০৯ সালে নরসিংদীতে বদলি হন। ৫১ দিনের মাথায় দুদকের মহাপরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড প্রসিকিউশন) হয়ে ফেরেন। কী জাদু। মুক্তিযোদ্ধা ওই বিচারক বেচারা। তিনি আওয়ামী মন্ত্রীদের সুপারিশ জোগাড় করেন, কিন্তু ঢাকায় একটি বদলি জোটে না।
আরেকটি উদাহরণ দিই। ঢাকায় কর্মরত একজন জ্যেষ্ঠ জেলা জজকে (যাঁর অবসর আসন্ন। বিধিমতে, তাঁর বদলি এখন শর্তসাপেক্ষ) খুলনায় বদলির প্রস্তাব করা হয়েছে। ৬ অক্টোবর ২০১০ আইন মন্ত্রণালয়ের ওই প্রস্তাব-সংক্রান্ত চিঠিটি একটি খাসা দলিল বটে। আগের লেখায় বলেছিলাম, একটি বদলি নীতিমালা হোক। ঢাকায় যাঁদের দীর্ঘকাল কেটেছে, তাঁদের বদলি করা হোক। এই মুহূর্তে পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে ঢাকায় থাকা জজের সংখ্যা প্রায় এক ডজন হবে। আসলে কতিপয় চেনামুখের একটি বলয় গড়ে উঠেছে। এঁরা ঘুরেফিরে ঢাকায় থাকেন। সে কারণে ৬ অক্টোবরের চিঠিটির একটি বাক্য আমাকে বেশ আকৃষ্ট করেছে। এতে লেখা আছে, ‘ঢাকায় তাঁর একটানা প্রায় পাঁচ বছর কর্মকাল হয়েছে। ফলে তাঁকে অন্যত্র বদলি করা আবশ্যক।’ আমরা আশা করব, এতে ব্যক্তিবিশেষের প্রতি নয়, এর মধ্যে সরকারি নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অন্তত সুপ্রিম কোর্ট সেভাবে নেবেন। সেটা নিতে তাঁরা ব্যর্থ হলে প্রহসন থামানো যাবে না।
আইন মন্ত্রণালয়ের তিন উপসচিব পদে তিন জজকে ‘সততা, যোগ্যতা ও দক্ষতা’ বিবেচনায় বদলির প্রস্তাব করা হয় একই দিনে। এতেও অভিনবত্ব আছে। তবে এটাই হোক প্রকৃত নীতি। এসব হয়তো ১৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা জিএ কমিটির বৈঠকে গেছে। প্রধান বিচারপতি জিএ কমিটি পুনর্গঠন করেছেন। হাইকোর্টের তিন বিচারক—আনোয়ারুল হক, এ কে এম ফজলুর রহমান ও হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে নিয়ে এই কমিটি হয়েছে। প্রথম দুজন জেলা জজ ছিলেন। তাই অনেকেই কমিটির পয়লা সিদ্ধান্তে বজ্রাহত হয়েছেন। কারণ, এক দিনও কোনো জেলায় জজিয়তি (জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে) করেননি। তেমন ব্যক্তি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ হবেন, সেটা গত ২০০ বছরে কেউ কল্পনা করেনি। তা ছাড়া এর আরও মাত্রা আছে। এক অর্থে এটা একটা অভ্যুত্থান। কারণ, ঢাকার জেলা জজ ছিলেন জ্যেষ্ঠ তালিকার শীর্ষে। তিনিই ছিলেন সমিতির সভাপতি। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তাঁকে এক বছর যেতেই সরানো হয়। অথচ যোগ্য বিবেচনায় তাঁকে হাইকোর্টের বিচারক করতে সুপারিশ করেছিলেন প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন।
দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারককে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের আগেই একটি রিট করা হয়েছিল। এতে প্রতিকার চাওয়া হয়, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে যাতে জ্যেষ্ঠতা বজায় রাখা হয়। এর শুনানি মুলতবি আছে। আমরা মনে করি, ঢাকা জেলা জজ নিয়োগের বৈধতাও রিটে চ্যালেঞ্জযোগ্য। ওই বিচারকের এসিআরে একাদিক্রমে চার জেলা জজ মন্তব্য করেছিলেন, তাঁর মামলা নিষ্পত্তির হার ‘অপর্যাপ্ত’। আওয়ামী ঘরানার অথচ অধিকতর যোগ্য এবং এসিআরও নিষ্কণ্টক, এ রকম জজ প্রথম জ্যেষ্ঠ ১০০ জনের মধ্যেও ছিল না, সেটা আমরা স্বাভাবিক বলে ভাবতে পারি না। আমরা ভাবতে পারি না, জোট সরকারের আমলে (২০০৬) একজন জেলা জজ (তিনি আবার ওই জজের ভগ্নিপতি) কী করে দূতাবাসে বদলি হন, এখনো বহাল থাকেন? আমরা বুঝতে পারি না, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কেন চিঠি দেয়। সুপ্রিম কোর্ট কী করে তা মেনে (গত অক্টোবর) নেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি পদে এক জেলা জজকে বসান। একজন লিয়েনে জাতিসংঘ মিশনে দুবার গেছেন। তাই বলি, বিচার প্রশাসনে প্রহসন চলছে।
প্রধান বিচারপতির একক ইচ্ছায় জিএ কমিটি হয়। কেবল হাইকোর্ট বিভাগ থেকে এতে বিচারক নেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর থেকেই এই ধারা চলছে। তবে এর মাধ্যমে সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটছে। জিএ কমিটিতে আপিল বিভাগের বিচারক রাখতে হবে। সংখ্যা বাড়াতে হবে। জিএ কমিটি ভেঙে নতুন আঙ্গিকে কোনো কাঠামোর কথাও ভাবা যায়। জরুরি অবস্থায় আমরা প্রধান বিচারপতি মো. রুহুল আমিনের একটি অত্যাশ্চর্য সংস্কার প্রস্তাবের কথা স্মরণ করতে পারি। তিনি ফুলকোর্টে প্রস্তাব এনেছিলেন, জিএ কমিটির সুপারিশ আর ফুলকোর্টে যাবে না। সেই সুপারিশ প্রধান বিচারপতির কাছেই পেশ করতে হবে এবং তিনিই তা চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করবেন। এ থেকে আমরা গন্ধ পাই। প্রধান বিচারপতিরা জজ নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগের একটা প্রবণতা দেখান। এটি মূলগতভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এটাই আমাদের পেছনে ফেলতে হবে।
১৯৯৬ সালে ফুলকোর্টের একটি সিদ্ধান্ত ছিল। তাতে প্রধান বিচারপতিকে জজ বদলি ইত্যাদি প্রশ্নে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে ফুলকোর্ট সেটা বাতিল করেন। তাঁরা জিএ কমিটিকে সব এখতিয়ার দিয়েছেন। আসলে ওই সিদ্ধান্তও সংবিধানসম্মত হয়নি। কারণ, আপিল বিভাগকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। তবে এখন জিএ কমিটিকে এড়িয়ে কাউকে বদলি করা একেবারেই বেআইনি হবে। সরকারি ইচ্ছায় সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার দপ্তরে অপসারণ ও আগমনী গান বড় বেসুরো ঠেকছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটা লড়াই অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট কি রণে ভঙ্গ দিলেন? ১১ অক্টোবর ২০০৯ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার মো. শওকত হোসেন (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারক) আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। সেটি জজদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলাসহ নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ প্রদান ও বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর সুপ্রিম কোর্ট একটি অবস্থান নিচ্ছিলেন। তাঁরাও প্রয়োজনে কোনো বিচারককে বদলির প্রস্তাব করতে পারবেন। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় তা মানতে রাজি হয়নি। এখানে একটা পরিহাস আছে। আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে থাকা জজ সাহেবরাই সরকারকে (মহলবিশেষ) পরামর্শ দেন যে এসবে সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার নেই। আর তাঁরাই যখন সুপ্রিম কোর্টে প্রেষণে আসেন, তখন তাঁরাই উল্টো পরামর্শ দেন। এর মানে হলো, ‘ক্ষমতা, তোমায় বড় ভালোবাসি।’
দুই তরফেই আমরা অবশ্য অস্বচ্ছতা ও অন্যায্যতা দেখেছি। এর বহু প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। তবে আমাদের একটি জায়গায় দাঁড়াতে হবে। আর সেটা হলো, বিচারক নিয়ন্ত্রণের ভরকেন্দ্র একটিই থাকবে। আর সেটা হতে হবে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত মানে কী, সেটা ঠিক করতে হবে। কোনো ধরনের কর্তৃত্বপরায়ণ, ব্যক্তির মেজাজ-মর্জিনির্ভর কোনো সিদ্ধান্তকে সুপ্রিম কোর্টের বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না। আইন মন্ত্রণালয় চাইছে, তারা যখন খুশি যাঁকে ইচ্ছা তাঁকে বদলির প্রস্তাব দেবে। সুপ্রিম কোর্ট রাজি না হলে অগ্রাহ্য করবে। কিন্তু নিজ থেকে বিকল্প প্রস্তাব বা সুপারিশ দিতে পারবে না। সুপ্রিম কোর্ট ইদানীং সেই ফতোয়া মেনে নিচ্ছেন। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরও হুমকির মুখে পড়ছে।
সুপ্রিম কোর্টকে অবশ্যই অধিকতর উন্নত ও স্বচ্ছ প্রস্তাব দিয়ে আইন মন্ত্রণালয়কে উপযুক্ত পাঠ দিতে হবে। শুধু সংবিধান ও রায় দেখিয়ে এ ধরনের অধিকারের অসতর্ক কিংবা অন্যায্য অনুশীলন সুফল দেবে বলেও মনে হয় না।
আমরা পঞ্চম সংশোধনী নিয়ে মাতম দেখছি। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি অনেক উত্তেজনাকর উক্তি দিচ্ছেন। আমরা শিগগিরই মুদ্রিত অবস্থায় নতুন সংবিধান পাচ্ছি। শুধু আফসোস হলো, সংশোধনীগুলোর সঙ্গে শাসনগত গুণগত মান বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। এসব সংশোধনীর আত্মা ও শ্বাসযন্ত্র হলো রাজনীতি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো। সেই স্বাধীনতা বাহাত্তরে মূল সংবিধানেই ন্যুব্জ ছিল। কারণ, বিচার বিভাগ কার্যকরভাবে পৃথক না করে তখন আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। উপরন্তু চতুর্থ সংশোধনীতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো ১১৬ অনুচ্ছেদ। এটা বাহাত্তরের সংবিধানের আদলে (তাহলে সব ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্ট ফিরে পাবেন) ফিরিয়ে আনতে হবে। সেটা না পাওয়া পর্যন্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ‘বাদ্যযন্ত্রের দূরবর্তী শব্দ’ হয়েই থাকবে। এটা বিচারপতি মো. আবদুল মতিনের উপমা। ১০ বিচারকের মামলায় তিনি যথার্থ অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে সে কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলাম। কিন্তু কথায় চিঁড়ে ভেজে না।
বিএনপি-আওয়ামী লীগ উভয়ে আদালত তাঁবে রাখতেই এককাট্টা। অনেকে সুপ্রিম কোর্টের জন্য স্বাধীন সচিবালয়ের কথা বলেন। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতিকে সচিবালয় গঠনের তাগিদ দিয়েছিলেন। সেই বিষয়ে বঙ্গভবন থেকে একটি পত্র পাঠানো হয় আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ে। সেটি ফিতাবন্দী হয়ে থাকার কথা, থাকছেও তা-ই।
একটি বিকল্প বলি। একটু নাটকীয় বটে। এত নাটকীয়তার মধ্যে বলতে দোষ কী! মাসদার হোসেন মামলার শুনানি কিন্তু এখনো চলমান। এখানে একটি সম্প্রসারিত বিচারিক উদ্যোগ হতে পারে। আদালতের স্বাধীনতায় সরব আইনজীবীদের কমতি নেই! তাঁদের বক্তব্য শুনে বর্তমান ১১৬ অনুচ্ছেদকে (যা দিয়ে সরকার নিম্ন আদালতের হাত মোচড়ায়) সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী ঘোষণা করা সম্ভব মনে করি। এবং সেই রায়েই বলে দেওয়া যায়, বাহাত্তরের সংবিধানে মূল ১১৬ অনুচ্ছেদটি পুনরুজ্জীবিত হলো। সংসদের দরকার নেই। বিজি প্রেস থেকে ছেপে নিলেই হলো। আহা এমন যদি হতো!
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।